নিউইয়র্ক
প্রজন্মের বৈসাদৃশ্য ও প্রসঙ্গ কথা।
কিছু দিন আগের কথা, আমি সে সময় বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের গবেষণা শাখার দ্বায়িত্বে।আমার বস হিসেবে যোগ দিলেন আমার বেশ কয়েক ব্যাচ সিনিয়রএকজন কর্মকর্তা। যিনি পুর্ববর্তী একটি সরকারের প্রতি অনুরক্ত থাকা সহ নানা কারণে পদোন্নতি বন্চিত হয়ে শেষতক সংসদ সচিবালয়ে পদায়িত হন।অবসরে যেতে তার অল্পদিন বাকী। বয়স কিংবা বাৎসল্য যে কারনেই হোক উনি বোধ হয় আমাকে বেশ পছন্দ করতেন।সুযোগ পেলেই ডাকতেন গল্প করতে। সে গল্পে উপেক্ষিত হতো বয়সের ব্যাবধান, পারিবারিক সীমানা ইত্যাদি। স্যার তার গল্পে ভাবীর সৌন্দর্যে তার মুগ্ধতা, প্রতিবন্ধী ছেলের ভবিষ্যৎ চিন্তা আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া জোষ্ঠ পুত্রের আচার আচরণ নিয়ে তার অতৃপ্তির কথা বলতেন। ভালোই কাটছিল আমাদের সময।কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই ভোকাট্টা ঘুড়ির মতোই তিনি চলে গেলেন, তার এ চলে যাওয়াটা আমার কাছে ছিল অকস্মাৎ, অনাকাঙ্ক্ষিত, বেদনার তো বটেই। খবর পেয়ে ছুটে গেলাম। শবদেহ তখন গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবার তোড়জোড় চলছে।স্যারের সাথে ওটাই ছিল শেষ দেখা।খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার পাশে স্যারের জোষ্ঠপুত্র দাড়িয়ে। বারবার ই সে বাবার নিথর দেহটা ছুয়ে বলছিল,”সরি আব্বু সরি”। আশে পাশের কেউ না বুঝলেও আমি বুঝতে পারছিলাম তার এই “সরি”বলাটার রহস্য।
এখনো কোন কোন অবসরে স্যারের কথা ভাবলে এই”সরি”টা আমাকে খুব জ্বালায়। মারা যাবার কয়েকদিন আগে স্যার বলছিলেন তার ছেলের কথা, আজকালকার ছেলেমেয়েদের আধুনিকতা,জেনারেশন গ্যাপ বা প্রজন্মের বৈসাদৃশ্য সহ নানা কথা।প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন ছেলের আধুনিকতায় বাধা দিতে গিয়ে নিগৃহীত হবার কথা ও।
আমাদের এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা আজকাল নিজেদের আধুনিক ভাবতে গিয়ে ভুলে যায় যে তাদের বাবামা ও তাদের নিজেদের সময়ে আধুনিক ছিল।পার্থক্যটা কেবল সময় আর দৃষ্টিভঙ্গির।এখনকার আধুনিকতায় শৃংখলা নেই, নেই যতি বা বিরামের বালাই। আকাশ সংস্কৃতির কালো থাবায় বিশীর্ন হয়ে পড়েছে পুরো প্রজন্ম।এদের কাছে আবেগ নয় পরাবাস্তবতাই আসল।ডারউইনের”Survival of the fittest”থিওরী বোধকরি এদের কথা ভেবেই প্রনীত হয়েছিল। তাই এদের বেগ আছে কিন্তু নেই আবেগ।সারা রাত জেগে সারাদিন ঘুমায় বলে ভোরের স্নিগ্ধতা এদের স্পর্শ করেনা,বৃষ্টি,কাদামাটির সোদা গন্ধ, জোৎস্না রাত,ঝি ঝি পোকার শব্দ, বৃষ্টি শেষে রংধনুর রংয়ের খেলা কিছুই ভাবায় না এদের। আমাদের মত যাদবের পাটগনিত করতে গিয়ে গলদঘর্ম হওয়া,অবসর সময়ে বিনোদনের অনুসঙ্গ হিসেবে বইকে বেছে নেয়া , ভরসন্ধ্যায় আবশ্যিকভাবে ঘরে থাকা, সকাল সন্ধ্যায় উচ্চস্বরে পাঠ মুখস্থ করার মতো বোকা এরা নয়। ক্যালকুলেটার টিপে বা গুগলের কল্যানে মুহুর্তেই সব জয় করছে তারা।মেধা বা শরীরের চর্চা নয় ফাষ্টফুড খেয়ে বিনাশ্রমে সবকিছু জয়ের আকাঙ্ক্ষা এদের।দিনের আলো পছন্দ নয় তাদের। ওদের কাছে তাই আমাদের প্রজন্মের Early to rise, early to bed থিওরী ভুল, সেকেলে।
নিজের প্রতিষ্ঠা,প্রাপ্তি আর সাফল্যের ঠিকানা খুজতে মানবিকতা, পিতৃত্ব মাতৃত্ব উপেক্ষিত ওদের কাছে।বৃদ্ধদের নিয়ে নচিকেতার গানই এখন পরাবাস্তবতা।সমাজে তাই বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বাড়ছেই, বাড়ছে সামাজিক বন্চনার অভিঘাত ও।
অবশ্য এ প্রজন্মের মানসিক বৈকল্যের দায়টা কেবল ওদের নয় আমাদের ও । আমাদের প্রজন্মে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের বাবা মায়েরা যত বেশী বন্ধু ছিলেন তার চেয়ে বেশী ছিলেন অভিভাবক।ফলে মায়ের কাছে রাজ্যের সব দাবিদাওয়া করা গেলে ও বাবাকে আমরা যেমন ভালবাসতাম ভয় ও পেতাম যথেষ্ট ই ।ফলে পরিবারে একটা অলিখিত ভারসাম্য থাকতো। কিন্তু এখনতো পুরো বিষয়টি উল্টো । আমাদের দায়টা তাই বাহুল্যের ,দায়টা অতিরন্জন বা আতিশয্যের।সেইসঙ্গে বিভাজনের ও ।আমাদের প্রজন্মে পরিবারে ভাইবোনের সংখ্যা ছিল বেশি ,বাবা মা অন্নবস্ত্রের সংস্থান করতে গিয়ে সবার প্রতি সমান নজর দিতে পারতেন না ।তাই বড় হবার চেতনাটা জাগ্রত হতে হতো যারযার নিজের ভেতর থেকে।যারা পড়াশুনা করতো,শৃংখলা মেনে চলতো তারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতো অন্যরা ঝড়ে যেতে অমোঘ নিয়মেই। আমাদের প্রজন্মে যৌথ পরিবারের কাঠামোটা তবু বেচে ছিল। তাই আমরা সবাইকে নিয়ে ভালো থাকার কথা ভাবতে পারতাম।কিন্তু এখন? যৌথ পরিবারের ধারণা বিলুপ্তপ্রায় আধুনিকতা,শহুরেপনা,আত্ম কেন্দ্রিকতা,সহনশীলতার অভাব, নীতিহীন স্বার্থপরতার কারণে একক পরিবারের কাঠামো ও এখন খাদের কিনারায়। এর দায় কিছু হলেও আমাদের আছে।
আমাদের সময়ে বাল্যশিক্ষার পাঠ ছিল “সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি”আর এখনকার পাঠ হচ্ছে “হাট টিমা টিম টিম, তারা মাঠে পাড়ে ডিম,তাদের খাড়া দুটো শিং” কি অদ্ভূতুড়ে?নীতিহীন। আজ কয়টা পরিবারে তার সন্তানদের শেখায় শব্দ করে খাওয়া যাবে না, খাওয়া শেষ হয়ে গেলেও বড়দের অনুমতি নিয়ে টেবিল ছাড়তে হবে, সিনিয়র কাউকে দেখলে সালাম দিতে হবে,বাসে মহিলাদের জন্য বসার সিট ছেড়ে দিতে হবে, চলৎশক্তি হীন কাউকে দেখলে হাতধরে রাস্তাপার করে দিতে হবে।
স্বল্প সংখ্যক সন্তান থাকায় আজকাল বাবা মার আদিখ্যেতা,আতিশয্যের শেষ নেই।আমাদের সময় পোশাক আশাকের বাহুল্য ছিল না,প্রয়োজনাতিরিক্ত পোশাক, সাজসজ্জা ছিল বখাটেপনা । অথচ এখন? বাবামায়ের অবিমৃশ্যতায় কমতি নেই শিশুর পোশাক আশাক খেলনাপাতির । ফলে সে বুঝতেই পারে না এই বাহুল্যটা দিতে বাবামায়ের কষ্ট,আত্মত্যাগের কথা।এতে কষ্ট করে পাওয়ার অন্তর্গত শিক্ষাটি শিশুর জন্য থেকে যাচ্ছে অধরাই।
যখন যা চাওয়া যায় তাই পাওয়া যায় এমন একটা প্রবনতা মজ্জাগত হয়ে উঠায় এ প্রজন্মের সন্তান দের ক্ষেত্রে প্রত্যাশা প্রাপ্তির অমিল হলেই ঘটে যায় বিপত্তি।সমাজের অতি আদরে বেড়ে উঠা ঐশীরা তাই বাবা মার বুকে চড়ে অবলীলায় ছুড়ি চালায়।ভুলে যায় বাবার ঐ বুকে শুয়ে শুয়ে সে বড় হয়েছে, তার মুখে খাবার তুলে দেবার জন্য কেবল উপার্জন নয় কতো না কসরৎ করতে হয়েছে তাকে।যে মাকে এখন তাদের বোকা আউটডেটেড মনে হয় সেই মা ই নিজের রক্ত মাংসে তাকে পৃথিবীর আলো বাতাস দেখিয়েছে, সুস্থ রাখার জন্য কত নির্ঘুম রাত্রি যাপন করেছে।আজকাল কিছু কিছু ছেলেমেয়ের বাবামায়ের ভুল ত্রুটির হিসেব করতে দেখে কষ্ট হয়।।নারীবাদ, পুরুষবাদসহ নানা মতবাদের এ যুগে এটা হয়তো স্বাভাবিক ঘটনা।কিন্তু এটা স্বাভাবিক নয় আমাদের প্রজন্মের সব বাবা মায়ের জন্য। যারা ওদের দৃষ্টিতে বোকা, আউটডেটেড ।কারণ বোকারা তো বোকা ই।বোকারা তো যুক্তি মানেনা। কোন কিছু না ভেবে ,লাভালাভের কথা বিবেচনায় না এনে উদ্দেশ্যহীনভাবে ডালবাসে।এতো নিগ্রহ এতো বন্চনা তারপরও সন্তানের শুভ কামনায় তারা কি একাগ্র?, সন্তানের সাফল্যে কি নির্মোহ ভূবনজয়ী আনন্দ তাদের ? প্রশ্ন হচ্ছে এ প্রজন্মের সন্তানেরা কি সেটা বুঝতে পারে?
হ্যা সন্তান ও হয়তো একসময় সেটা অনুভব করতে পারবে যখন সে অবতীর্ণ হবে বাবা মায়ের ভূমিকায়।কিন্তু ততক্ষণে তো অনেক বেলা হয়ে যাবে ।অস্পৃশ্যতা হয়তো বিভাজনের দেয়াল তুলে দেবে দু প্রজন্মে।সর্বত্যাগী আমাদের বোকা প্রজন্মের বাবা মায়েরা হয়তো জানতেই পারবে না তার সন্তানেরা এখন তারই ভূমিকায়,তারই মতো প্রতিক্রিয়ায় ।একই রকম ভাবে কষ্ট পাচ্ছে। কেটে যাচ্ছে কিন্তু রক্ত বেরুচ্ছে না।অথচ এমনটা তো হবার কথা ছিল না।এমনটাতো হতে নেই।
এবারের ছবিটি আমার মেজো মেয়ে শ্রেষ্ঠার।এস এস সি তে জিপিএ-৫ পাওয়া উপলক্ষে অফিসার্স ক্লাবে দেয়া সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে তোলা।
লেখক: সরকারি কর্মকর্তা
এই বিভাগের আরও খবর
মা ও স্ত্রীকে নিয়ে আমান আযমীর আবেগঘন পোস্ট ভাইরাল
মা ও স্ত্রীকে নিয়ে আমান আযমীর আবেগঘন পোস্ট ভাইরাল
বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে আসিফ নজরুলের আবেগঘন স্ট্যাটাস
বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে আসিফ নজরুলের আবেগঘন স্ট্যাটাস
তাহসান-মিথিলা-রোজাকে নিয়ে যা বললেন অরুণা বিশ্বাস
তাহসান-মিথিলা-রোজাকে নিয়ে যা বললেন অরুণা বিশ্বাস
তাহসানের বিয়ের খবরে ছবি দিলেন মিথিলাও
তাহসানের বিয়ের খবরে ছবি দিলেন মিথিলাও
‘অল আয়েজ ওন থার্টিফার্স্ট ডিসেম্বর, নাউ ওর নেভার’: কি ঘটবে সেদিন
‘অল আয়েজ ওন থার্টিফার্স্ট ডিসেম্বর, নাউ ওর নেভার’: কি ঘটবে সেদিন
ফারুকীর ‘৮৪০’ দেখে যা বললেন পাকিস্তানের হাইকমিশনার
ফারুকীর ‘৮৪০’ দেখে যা বললেন পাকিস্তানের হাইকমিশনার
ভোররাতে মমতাকে নিয়ে ফেসবুক স্ট্যাটাসে যা বললেন ফখরুল
ভোররাতে মমতাকে নিয়ে ফেসবুক স্ট্যাটাসে যা বললেন ফখরুল
ভারতকে শান্তিরক্ষী বাহিনীর সহায়তা নেওয়ার পরামর্শ আসিফ মাহমুদের
ভারতকে শান্তিরক্ষী বাহিনীর সহায়তা নেওয়ার পরামর্শ আসিফ মাহমুদের
আন্দোলন ছাড়া দিনটা গেলে মনে হয় ‘কি যেন নাই’
আন্দোলন ছাড়া দিনটা গেলে মনে হয় ‘কি যেন নাই’
ফেসবুকে পোস্ট করে আলোচনার সৃষ্টি করলেন অপু বিশ্বাস
ফেসবুকে পোস্ট করে আলোচনার সৃষ্টি করলেন অপু বিশ্বাস
আমাদের শেষ দেখাও হলো না: পরীমণি
আমাদের শেষ দেখাও হলো না: পরীমণি
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসিফের দীর্ঘ পোস্ট
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসিফের দীর্ঘ পোস্ট